লায়লা আরজুমান্দ
আমেরিকান লোকগাথার একজন কিংবদন্তি জন হেনরি। দীর্ঘদেহী, সুঠাম, কালো বর্ণের হেনরি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন রেললাইন বসানোর কোম্পানিতে। বাস্তবে তার অস্তিত্ব ছিল নাকি ছিল না সেই বিতর্ক এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। পাথরে খোদাই করা হেনরির হাতের উত্তোলিত হাতুড়ি হয়ে উঠেছে সমাজের নিপীড়িত, বঞ্চিত শ্রেণির কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের
সবচেয়ে বড় ভরসা। জন হেনরিরা মরেও মরেন না, গানে গানে থেকে যান। লিখেছেন লায়লা আরজুমান্দ
মে দিবসের গানে
শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে পহেলা মে পালিত হয় বিশ্বব্যাপী। মে দিবস নিয়ে বিশ্বের প্রায় সব ভাষায়, সব দেশে লেখা হয়েছে প্রচুর গল্প, কবিতা আর উপন্যাস। নির্মিত হয়েছে সিনেমা। সংগীতশিল্পীরা গেয়েছেন প্রচুর গান। বাংলা ভাষায় শ্রমিকদের নিয়ে কোনো গানের কথা এলেই সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে জন হেনরি গানটির কথা।
‘জন হেনরি, জন হেনরি
নাম তার ছিল জন হেনরি
ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন
হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিল্পী
খুশি মনে কাজ করে রাত-দিন
হো হো হো হো
খুশি মনে কাজ করে রাত-দিন।’
গণশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা ও সুরে আমরা পরিচিত হই জন হেনরি নামে এক শ্রমিকের সঙ্গে। যিনি কিনা নিজের জীবন দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির মাথা উঁচু করে গেছেন। পাল্লা দিয়ে জয়ী হয়েছেন ইঞ্জিনচালিত মেশিনের সঙ্গে। শ্রমিক দিবস নিয়ে বাংলা ভাষায় যত গান রয়েছে তার মধ্যে এই গানটিকেই বলা হয় সব থেকে অনুপ্রেরণামূলক গান।
কিংবদন্তি জন হেনরি
জন হেনরি আমেরিকান লোকগাথার একজন কিংবদন্তি। তাকে নিয়ে গল্পের জন্ম হয়েছিল আফ্রিকান-আমেরিকান দিনমজুরদের মধ্যে। জন হেনরি রেলপথে স্টিল ড্রাইভারের কাজ করতেন। হাতুড়িই ছিল তার একমাত্র সম্বল। হাতুড়ি দিয়ে পাথর কাটা ছিল তার কাজ। লোকগাথায় বলা হয় জন হেনরি যন্ত্রের সঙ্গে হাতুড়ি হাতে প্রতিযোগিতায় নেমে জিতেছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তার এ কাহিনী নিয়ে অসংখ্য গান, গল্প, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছে বিশ^জুড়ে।
জন হেনরির কিংবদন্তির রয়েছে অনেকগুলো সংস্করণ। কোনো কোনো সংস্করণে বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন একজন জেলের কয়েদি। প্রায় সবগুলোতেই বলা হয়েছে তিনি ছিলেন ক্রীতদাস। শারীরিকভাবে ছিলেন শক্তিশালী অন্য সবার থেকে। তার জন্ম সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ১৯ শতকের মাঝের দিকে তিনি আমেরিকার পূর্ব উপকূলে নির্মাণাধীন রেলপথে স্টিল ড্রাইভারের কাজ করতেন।
হাতুড়িই যার সম্বল
কালো শ্রমিক হেনরির একমাত্র সম্বল ছিল হাতুড়ি। ৬ ফুট দীর্ঘ আর ২০০ পাউন্ড ওজনের হেনরি যে কোনো শক্তিশালী কাজ করে ফেলতেন হাসিমুখে। তার ছিল ১৪ পাউন্ড ওজনের এক বিশাল হাতুড়ি। রেলপথ নির্মাণে তার সঙ্গে ছিল আরও অনেক শ্রমিক। কেউই হেনরির সঙ্গে কাজে পারতেন না। লোহার পাত বহন করা থেকে শুরু করে খচ্চরের পিঠে মোট বয়ে নিয়ে যাওয়া, হাতুড়ি ও বড় স্টিলের পেরেক দিয়ে পাহাড় খনন করাসহ নানা ধরনের কাজ করতে হতো শ্রমিকদের। সেই সময়ে শ্রমিকদের জীবন ছিল খুবই সাধারণ ও অবহেলিত। ছিল না কোনো আনন্দ। গর্ব করে বলার মতো তাদের কিছুই ছিল না। কিন্তু তাদের ছিল হেনরি। জন হেনরি। যাকে নিয়ে তারা গর্ব করতে পারতেন। অহংকার করতে পারতেন। বুক ফুলিয়ে বলতে পারতেন, জন হেনরির মতো শক্তিশালী মানুষ এই পৃথিবীতে আর নেই।
মেশিনকে করেছিলেন পরাজিত
রেললাইন তৈরি করার জন্য এক সময় পাহাড়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। রেলপথের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মতান্তরে মালিক সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন স্টিল ড্রিল মেশিন আনার। কারণ এই পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ করা কোনো শ্রমিকের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে সব থেকে বেশি আপত্তি ছিল শ্রমিকদের। কারণ তাহলে কাজ হারাতে হবে তাদের। মরতে হবে না খেয়ে।
যাকে নিয়ে ছিল শ্রমিকদের অহংকার ও গর্ব, যাকে শ্রমিকরা দলনেতা বলেও মানতেন সেই হেনরি এই সিদ্ধান্ত মানলেন না। বাধা দিলেন। করলেন প্রতিবাদ। কিন্তু প্রকৌশলী ছিলেন তার সিদ্ধান্তে অটল। এক সময় প্রকৌশলীর দিকে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেন হেনরি। বলেন মেশিনের থেকেও বেশি ও দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারবেন তিনি।
হেনরির কথা শুনে সাদা চামড়ার প্রকৌশলী হেসেই খুন। মেশিনের সঙ্গে নাকি পাল্লা দেবে মানুষ! এক সময় প্রতিযোগিতায় নামল মানুষ আর মেশিন। এবার তিনি হাতে তুলে নিলেন ২০ ফুট ওজনের হাতুড়ি। একদিকে মেশিন অন্যদিকে হেনরির হাতুড়ির শব্দ ধ্বনিত হচ্ছিল সবখানে। হেনরি জানেন তাকে জিততেই হবে। হারলে সব শ্রমিকের ভাগ্য পতিত হবে অন্ধকারে। পেটে ভাত দেওয়ার মতো কোনো উপায়
থাকবে না তাদের। জীবন বাজি রেখে প্রাণপণে কাজ করে গেলেন হেনরি। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার সেই রেল সুড়ঙ্গে শুধু হাতুড়ির খট খট শব্দ। হেনরির হাতুড়ির ঝলকে তৈরি হয় বিদ্যুৎ। সুড়ঙ্গের বাইরে তখন টানটান উত্তেজনা। গোপনে এসে সুড়ঙ্গে কান পেতে সেই খট খট শব্দ শুনে যান হেনরির প্রিয়তমা স্ত্রী মেরি ম্যাক ডেলিন। এক সময় প্রতিযোগিতার সময়ও ফুরিয়ে আসতে থাকে। হাতুড়ি হাতে হেনরি খুঁড়ে ফেলেছেন ১৪ ফুট আর মেশিন রয়েছে তখনো মাত্র নয় ফুটে। মেশিনকে হারিয়ে জয়ী হন হেনরি। শ্রমিকদের আনন্দ-চিৎকার আর জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে যায় পশ্চিম ভার্জিনিয়ার সেই রেল সুড়ঙ্গ এলাকা।
কিন্তু সেই আনন্দ বেশি সময় থাকেনি। হাত থেকে হাতুড়ি খসে পড়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হেনরি। না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেননি কোনোমতে। জীবন দিয়ে শ্রমিকদের মাথা উঁচু করে দিয়ে গেছেন তিনি। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত করে গেছেন লড়াই। ঘরে তখন তার পথ চেয়ে রয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রী ও ছোট্ট মেয়েটি। শিশুটি জানেও না তার বাবা আর ফিরবেন না কোনোদিন।
বিশ্বসংস্কৃতিতে জন হেনরি
জন হেনরির কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গান। মূলত তাকে নিয়ে দুই ধরনের গান দেখা যায়। একটি হলো ব্যালাড যা ‘জন হেনরির ব্যালাড’ নামে পরিচিত। আরেক ধরনের গান ‘হাতুড়ি সংগীত’ হিসেবে পরিচিত। তাকে নিয়ে ব্যালাডগুলোতে সাধারণত থাকে চারটি অংশ। জন হেনরির বাল্যকাল এবং স্টিল ড্রাইভিং, যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও মৃত্যু, কবর, তার স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া।
এখন পর্যন্ত প্রায় দুশোটি রেকর্ডেড ব্যালাড খুঁজে পাওয়া গেছে জন হেনরিকে নিয়ে। আফ্রিকান আমেরিকানদের ব্লুজ হিসেবে খ্যাত গানের মধ্যে এটাই প্রথম। প্রথম রেকর্ডেড কান্ট্রি সং-ও এই জন হেনরি ব্যালাড।
লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের লোকসাহিত্য গবেষকদের মতে এটা আমেরিকার সবচেয়ে বেশি গবেষণাকৃত লোকগান। অনেক সংগীতজ্ঞ তাকে নিয়ে লিখেছেন গান। যেমন হ্যারি বেলাফোন্ট, ফুরি লুইস, পিংক অ্যান্ডারসন, ই মেইনার, লিওন বিব, লিড বেলি, জনি ক্যাশ, পল রবসন, ব্রুস স্প্রিংস্টিন এবং আরও অনেকে। ২০০০ সালে ডিজনি জন হেনরি নামক একটি কার্টুন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। চলচ্চিত্রটি ২০০০ সালে গিফোনি চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে। ১৯৭৩ সালে লিক বোসটো এবং ডেভিড অ্যাডামস প্যারামাউন্ট পিকচারের জন্য একটি ১১ মিনিটের চলচ্চিত্র ‘জন হেনরির কিংবদন্তি’ নির্র্মাণ করেন। ১৯৭৪ সালে এটি অ্যাকাডেমিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।
১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ জন হেনরির ছবিসহ ৩২ সেন্টের ডাকটিকিট প্রকাশ করে। সুপারম্যানের কমিকস ‘The Death and Return of Superman’ এ একটি চরিত্রের নাম ছিল জন হেনরি যিনি একটা বড় স্টিল ড্রাইভিং হাতুড়ি বহন করতেন।
গত একশ বছর ধরে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক এবং লোকসাহিত্য গবেষক ধরে নিয়েছিলেন যে, জন হেনরি কিংবদন্তি মাত্র, কাল্পনিক এক চরিত্র। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু নতুন নতুন গবেষণায় অনেকেই চেষ্টা করছেন বাস্তবে জন হেনরি নামে কারও অস্তিত্ব তুলে ধরতে। তার জন্য উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত। কিন্তু কোনোটাই খুব বেশি জোরালো নয়। কোনো কোনো গবেষক দাবি করেন জন হেনরি নামে একজন বাস্তবে ছিলেন। সেই হেনরি ছিলেন জেলে। আর জেলের শ্রমিকদের দিয়েই তৈরি করা হতো রেললাইন।
কিন্তু জন হেনরি বলে বাস্তবে কেউ ছিলেন নাকি ছিলেন না, সেই বিষয়টা এখন অপ্রয়োজনীয়। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, নাগরিক অধিকার আন্দোলনে জন হেনরি এখন এক একক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন
পৃথিবীজুড়ে শ্রমিকরা আজও অবহেলিত, নির্যাতিত। পান না তাদের ন্যায্য মজুরি। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই অবস্থা ছিল আরও খারাপ। মানবেতর জীবনযাপন করতেন তারা। সে সময় শ্রমিকদের কোনো কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা ছিল না। ছিল না তাদের ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা। উপরন্তু ছিল মালিকপক্ষের অনবরত নির্যাতন। তাছাড়া তাদের কাজের পরিবেশ এতটাই খারাপ ছিল যে প্রায়ই ঘটত নানা ধরনের দুর্ঘটনা, আহত হতেন অনেক শ্রমিক। এমনকি মারাও যেতেন।
১৮৬০ সালে শ্রমিকরা দাবি জানান মজুরি না কমিয়ে তাদের কাজের সময় যেন করা হয় ৮ ঘণ্টা। আর এই দাবিতে তারা একটি সংগঠনও তৈরি করেন নাম ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’। এই সংগঠনের সেøাগান ছিল Eight hours for work, eight hours for rest, eight hours for what we will.
১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এ দাবি কার্যকরের জন্য শ্রমিকরা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সালের পহেলা মে পর্যন্ত। তবে মালিক-বণিক শ্রেণি ঐ প্রস্তাব আগে থেকেই প্রত্যাখ্যান করেছিল।
১৮৮৬ সালের মে মাসে বিদ্রোহ ওঠে চরমে। শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ার নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় হাজার হাজার শ্রমিক মিছিলের উদ্দেশে জড়ো হন। মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে একসঙ্গে শ্রমিকদের এত বড় জমায়েত আগে কেউ কখনো দেখেনি বা কল্পনাও করেনি। এ সময় তাদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের ওপর প্রবল আক্রোশে অতর্কিতে হামলা চালায়। তাতে অন্তত ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। এই মৃত্যুতে শ্রমিকের আন্দোলন আরও বেগবান হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে ছয়জনকে প্রহসনমূলকভাবে দোষী সাব্যস্ত করে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু এই মিথ্যা বিচারের অপরাধ শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ’-এর দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে পহেলা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে পহেলা মে পালিত হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় আশিটিরও বেশি দেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন। এছাড়া বেশ কিছু দেশে বেসরকারিভাবে পালিত হয় এই মে দিবস। (তথ্য সূত্র: দৈনিক দেশ রূপান্তর)